সে দিন এর পর নাওয়া খাওয়া সব কেমন যেন এলোমেলো হয়ে গেছে। মাথাটা ঝিম ধরে আছে।সবকিছু একটা গল্পের মত মনে হচ্ছে। কেউতো একজন আছে যে আমাকে এসব ভাবতে বাধ্য করছে। কেউতো একজন আছে যে আমাকে চেনে। কেউতো একজন আছে যে আমাদের গল্পটা জানে। বাধ্য হয়েই অবশ্য সেদিন বাড়ি ফিরতে হয়েছিলো। কারণ সেদিন আমার কাছে ফিরে আসা ছাড়া আর কোনো উপায় ছিলনা। বাড়ি এসে দেরাজ খুলে চিঠিটা হাতে নিলাম। খোলার সাহস পাচ্ছিনা। তারপরেও জানার আগ্রহে খাম থেকে লেখাটা হাতে নিলাম। পুরো শরীর যেন একদম ঠান্ডা হয়ে যেতে শুরু করলো সুজাতার হাতের লেখা দেখে। সহস্রবার এ লেখা আমি দেখেছি। এটা চিনতে আমার ভুল হবেনা কখনোই। শুরুতেই লেখা প্রিয় অতীত। অবাক হবার কথা এবং হলাম ও তাই। লেখা আছে বদলে গেছি আমি। বৃষ্টি আমার ভেতরকে আর স্পর্শ করেনা। আমি আর ঝুম বৃষ্টিতে ওর জন্য কদমগুচ্ছো নিয়ে অপেক্ষায় বসে থাকিনা। সূর্যাস্ত দেখিনা, দেখিনা জোৎস্না রাতে চাঁদের মায়া। এগুলো কখনই সুজাতার জানার কথা নয়। আমাকে বারবারই ভাবাচ্ছে যে আমি নাকি তাকে আর সেভাবে ভালোবাসি না। জানিনা কেন সবটা আমাকে নাড়িয়ে দিচ্ছে। যদি সুজাতা আমার নিজস্ব সৃষ্টি হয় তবে যা ঘোটে চলেছে আমার জীবনে তা সম্ভব কিভাবে? এর উত্তর আমাকেই খুজে বের করা লাগবে। জানি কেউ আমাকে কোনো সাহায্য করবেনা। তবে অবাক করা একটা ব্যাপার হলো আমি এসব ভাবছিলাম জোৎস্না দেখতে দেখতে। সুজাতা যাওয়ার পর আমার সকল ভাবনা ছিলো চার দেয়ালের মাঝে বদ্ধ এক অন্ধকার ঘরে। যেভাবেই হোক আমায় সব রহস্যের সমাধান করা লাগবে। মতিঝিলে সেই চেনা মুখ দেখা, সেই স্বপ্নের প্রাসাদ, চেনা মুখটার চেনা কিছু আচরণ, গেটের সামনে প্রাইভেট কার আর এই চিঠি। কেউ আমাকে কিছুতো অবশ্যই বলার চেষ্টা করছে। কিন্তু সেই কেউ টা আসলে ঠিক কে? আর কেনই বা এসব করছে।
শুনেছি দেহ বৃদ্ধ হয়ে গেলেও নাকি মনটা সেই তরতাজা যোয়ান রয়ে যায়। আমার বেলায় ব্যাপারটা হয়ত উল্টো বর্তে গেছে। দেহটা ত্রিশ ছুইছুই হলেও মনটা বোধকরি ষাট পার করেছে। ভাবনাগুলো ঝাপসা। চলার শক্তি হারিয়ে ফেলেছি। সময়ের কোনো হিসেব নেই। শেষ কটাদিন পাগলের মত ঘুরে বেড়িয়েছি আমি। সুজাতার খোঁজে। সেই সবখানে আমি গেছি যেখানে মোরা একসাথে ছিলাম কোনোদিন। মোদের হারিয়ে ফেলা স্মৃতি। চোখের কোণে জল এসেছে, ঠোটের কোণে মুচকি হাসির ছটা। পেয়েছি তাকে সবকিছু ছাপিয়ে। একটা বকুল বৃক্ষের নিচে দিব্বি আমার জন্য অপেক্ষা করে আছে। কাল আবার সেই উড়োচিঠি এসেছিলো। তবে এবার পিয়নজোগে। উপরে বড় করে লেখা ছিলো সুজানা জাফর। আমি একেবারে স্তব্ধ হয়ে গেলাম। চিঠিটা খুলে দেখাটা আমার জীবনের সবচেয়ে বড় ভুল ছিলো। চিঠির কথা না-হয় আজ থাক। দেখাটা সেই পুরোনো মাঠে বছর চারের পুরোনো ধাচেই। আমি কিছু বলার আগেই গাড়িতে উঠতে বলল। বাধ্য ছেলের মত আদেশ পালন করলাম। গাড়িটা গিয়ে থামলো জাফর ইকবাল সাহেবের বাড়ির ঠিক পিছনে। মানে সুজানা নামের মানুষটিরই। অবাক হলাম আমি। কারণ বাড়ির সামনেটা যতটা সাজানো পেছনটা ঠিক ততটাই প্রাধান্য পেয়েছে।সুজানা আমাকে নখ দিয়ে ইশারা করলো। সেদিকে তাকানোটা আমার জীবনের ক্রমাগত দ্বিতীয় ভুল।ইশারা লক্ষ্য করে এগিয়ে যাওয়া তৃতীয় আর বাকিটা হয়তো সবচেয়ে বড় সত্য। একটা বিশাল বকুল গাছ। তার নিচে একটা সাজানো ছোট্ট বাগান। একটা খোদাই করা পাথরে লেখা সুজাতা জাফর। আমি জ্ঞান হারাই। জ্ঞান ফেরার পর সুজানা আমাকে সবটা বলতে থাকে। তারা জমজ বোন। সুজাতা তাকে আমার সম্পর্কে সবকিছু জানাতো। চিঠিগুলো সবসময় সুজানাই লিখতো।বলত নাকি ভবিষ্যতের প্রস্তুতি। সেদিন যখন আমরা ফিরছিলাম আমাদের দু’জনকে একসাথেই ট্রাক ধাক্কা দেয়। কিন্তু আমার দুর্ভাগ্য আমি বেঁচে যাই। সুজাতা সেখানেই দেহ ত্যাগ করে। আর পুরো ঘটনাটা ঘটে জাফর ইকবাল অর্থাৎ সুজাতার বাবার নির্দেশে। একটি মাত্র উদ্দেশ্য। আমাকে সুজাতার জীবন থেকে দূরে সরানো। আর সে এই কাজে সফল হয়। তাই পরক্ষণেই সবকিছু ধামাচাপা দিয়ে দেয়। আমার অবস্থা দেখে ইচ্ছে করেই সুজানা আমায় এসে দেখা দেয়। এই সত্যিটা আমাকে জানাতে। সুজাতা এই পৃথিবীতে আর নেই। ওই লক্ষ-কোটি তারার মাঝে রোজ আমাকে দেখার মিথ্যে চেষ্টা করছিলো। আর আমি ছিলাম ওই বদ্ধ ঘরের মধ্যে। আমি অনেক কেঁদেছি।অপেক্ষা তো আমিও করেছি তাইনা! এখন এটা যেনে কষ্ট হচ্ছে এই অপেক্ষার পালা দীর্ঘ হতে চলেছে। ততদিন না-হয় ওই তারাতেই তোমার ছবি খুঁজবো। চোখ বুজে তোমার কোলে মাথা গুজবো।ভালো থাকব আমি।ঠিক তুমি যেমন ছিলে।
চলবে….
– শফিকুল বারী শিশির
ব্লগার, আতশি