স্বত্ত্বার সাথে একাকী সময় পার করা বোধহয় জীবনের সবচেয়ে কঠিন কাজ।আমি এই কঠিন কাজটাকে আপন করেছি আজ বহু বছর।
আমি তখন সবে অনার্স শেষ করেছি।চাকরী-বাকরীর কথা তখনো মাথাতেই আসেনি।সবেমাত্র ছাত্রজীবনের বেড়াজাল থেকে মুক্ত হয়েছি।তখনই কি অফিসের চার দেওয়ালের মধ্যে নিজেকে বন্দি করা যায়?সে কথা তখন ভাবাই যায়না।বয়স আঠাশ ছুঁইছুঁই।পুরোপুরি পৌরুষত্বের ছোঁয়া তখনও গায়ে ছুয়ে যায়নি।অনেক বন্ধুই বিয়ে করে সংসার সামলাচ্ছে।আমার তাতে কোনো আক্ষেপ ছিলোনা।নিজের মত ছিলাম মাঝে মাঝে বন্ধুদের সাথে আড্ডায় সময় ভালোই কাটছিলো।মাঝে একদিন হোটেলে বসে বোধকরি শিঙাড়া খাচ্ছিলাম।ঠিক তখনই কেউ এসে কাধে হাত দিয়ে বলল,”এইযে আমাদের একটু যায়গাটা ছেড়ে দিননা প্লিজ।বন্ধুরা একসাথে এসেছি।দেরি হয়ে গেলে ক্লাস মিস করে যাবো।”
তার কথা বলার ধরন আর একটু বাচ্চামি এক মুহুর্তে সবকিছু একদম এলোমেলো করে দিয়েছিলো।সেদিনের আর বলার মত কোনো কথা আর মনে পড়ছেনা।এরপর বহুবার সেই হোটেলে আমার যাওয়া হয়েছে কিন্তু তাকে পাওয়া যায়নি।ভেবেছিলাম ভাগ্যে আমার তাকে দেখার সৌভাগ্য আর নেই।তাই সব চিন্তা ছেড়েছুড়ে নিজের মত সময় পার করছিলাম।মাঝে কয়েকদিনের জন্য মামা বাড়ি যাওয়াতে সেই মেয়ের কথা পুরোই ভুলে গিয়েছিলাম।সত্যি বলতে মামার বাড়িতে গেলে আমি পৃথিবীর সব ভুলে যেতাম।যখন ফিরে এলাম তখন মাস দেড়েক পার হয়েছিলো হয়ত।তখন আর হোটেলে যাবার কোনো উদ্দেশ্য ছিলোনা।কিন্তু কেনো যে গিয়েছিলাম মনে পড়েনা।সেদিন ওখানে তারা অর্থাৎ ওই মেয়েটি আর তার সাথীরা উপস্থিতই ছিলো।আমি গিয়ে পাশের এক টেবিলে বসে শিঙাড়া চাইতেই ওরা আমার দিকে ইশারা করে কিছু বলছিলো।আমার বোঝার ভুল ভেবে এড়িয়ে যাবার আগেই আমার সামনের চেয়ারে কেউ একজন এসে বসলো।সামনে তাকাতেই দেখলাম এতদিন যে মেয়েটিকে নিয়ে আমার ভাবনা ছিলো সে।আমার খাবার চলে এলো তাই তার দিকে না তাকিয়ে খাওয়াটাই শ্রেয় ভেবে একটা শিঙাড়া মুখে তুলেছি।সামনে চুপ করে বসে থাকা মানুষটা হঠাৎ বলে উঠলো,এতদিন কোথায় ছিলেন?খাবার যেন মাঝপথে আটকে গেলো।খুব দ্রুত পানি মুখে দিয়ে কোনোমতে গলাধঃকরণ করে জিজ্ঞাসা করলাম,মানে?অকপট উত্তর,কোথায় ছিলেন এই দেড় মাস যাবত?না চায়ের দোকানে ছিলেন।না গোলির ক্যারামে আর না এখানে।কোথায় উধাও হয়েছিলেন?
সবটা বাউন্সারের মত মাথার ওপর দিয়ে গেলো।বললাম আপনি কি বলছেন আমি কিছুই বুঝে উঠতে পারছিনা।একটু বুঝিয়ে বলবেন?
সেখানে তার বোঝানোর অনেক কিছু ছিলো তবুও সে চুপ ছিলো।একটা কাগজ হাতে গুঁজে দিয়ে সে প্রস্থান করে।আর গল্পটা এখান থেকেই শুরু।
কাগজের লেখাটা নিতান্তই তুচ্ছ হলেও।তার গভীরতা ছিলো অনেক বেশি।শুধু খুব গুছিয়ে লেখার সুবুদ্ধি তখনও হয়নি নইলে অতি উত্তেজনায় সবটা গুলিয়ে ফেলেছে।হাতের লেখাটা কিন্তু অসম্ভব সুন্দর।তবে তার নামটা জানা গেলো।পরিচয় দিয়েই শুরু করেছে।সবাই যেখানে শুরু করে প্রশ্ন করে আর শেষটায় নাম।এখানে ঠিক তার উল্টো।নামটাও অপরূপ সুন্দর,সুদিপ্তা।আমারই ভার্সিটির বিবিএ তৃতীয় বর্ষের ছাত্রী।আমায় চেনে ভর্তি হবার পর থেকেই।ওই ক্যাম্পাসে সামাজিক সচেতনতা বৃদ্ধি নিয়ে কাজ করা হত সেই সুত্রে।কিন্তু তাতে কোথাও লেখা ছিলোনা কেন সে আমার সামনে এসেছিলো আর কেনই বা এই কাগজ দিয়ে গিয়েছিলো।শুধু সবশেষে খুব যত্ন করে লেখা ছিলো ভালো থাকবেন।তখন ওসবের অর্থ আমি বুঝে উঠতে পারিনি।কিন্তু এত বছর পরে সব যেন পানির মত স্বচ্ছ মনে হচ্ছে।
সেদিন তাকে দেখার খুব ইচ্ছা ছিলো সত্যি কিন্তু সাহস হয়ে ওঠেনি।হঠাৎই যেন সময় বদলে গেলো।খাওয়া-দাওয়া মাথায় উঠেছিল।ক্লান্তির লেশমাত্র ছিলোনা আর ঘুম সেতো দূরের কথা।কি হচ্ছে আর কি হবে এই সংশয়ে সপ্তাখানেক আর বাইরে যাইনি।কি হচ্ছিলো কিছুই ভেবে পাচ্ছিলাম না।কারণ এর পূর্বে এমন অনুভূতি আমার কোনোদিন হয়নি।বাবাতো বলেই বসলো মা চলে যাবার পরে নাকি আমাকে এমন খুশি কখনোই দেখেনি।নিজের কাছে নিজেকে অচেনা মনে হচ্ছিলো।বারবার আয়নাতে নিজের চেহারা দেখে কি কান্ডটাই না করেছি।
সেদিন কিছুটা অন্য বেশে বাড়ি থেকে বেরিয়েছিলাম।অন্য যেকোনো সময় হলে হয়ত আমি নিজেকে নিয়েই হাসি ঠাট্টা করতাম।কিন্তু তখন আমার কাছে ওটাই শ্রেয় ছিলো।সে কারণ যে একবার প্রেমে পড়েছে সেই বুঝতে পারবে।আর সেদিন যখন তাকে দেখলাম আমার হৃদস্পন্দন স্কুলের ঘন্টার মত বাজতে শুরু করলো।তাকে অন্য সব দিনের চেয়ে আলাদা মনে হচ্ছিলো।কিন্তু এমন হবার মত কোনো কারণই ছিলোনা।কারণ সে কাগজে তেমন কিছুই লেখেনি।দূর থেকে সে এসে আমার সামনে দিয়ে বেরিয়ে গেলো।সব জল্পনা-কল্পনা একেবারে এক মুহুর্তে শেষ।ভেবেছিলাম কাছে এসে কত কথা বলবে।তা আর হলোনা।আর তখনই নিজেকে পৃথিবীর সবচেয়ে বড় দুর্বোধ মনে হচ্ছিলো।এক মুহুর্ত আর দেরি হলোনা সোজা নিম্ন মস্তকে বিদায়।
চলবে….