সেদিন শরতের সন্ধ্যায় বাড়ি ফিরছিলাম। হঠাৎ কোথা থেকে এক লরি এসে আঘাত হানলো আমায়। মুহূর্তেই জ্ঞান হারাই। ভেবেছিলাম এই পৃথিবী হয়ত আমাকে বিদায় দিচ্ছে। আমার সাথে ছিলো সুজাতা। সুজাতা আমার সবচেয়ে কাছের মানুষ। ভালোবাসি, তবে খুব ভালো বন্ধু হিসেবে। তার প্রতি আমার ভালোবাসায় তার বিন্দুমাত্র আস্থা নেই। তা যদিও আমারও নেই। তবে সেদিন দুর্ঘটনায় শুধু আমি আহত হইনি, সে ও হয়েছিলো। সেদিন আর সুজাতার খোঁজ নেওয়া হয়ে ওঠেনি। আমার বন্ধু সাহেদ কে বলেছিলাম খোঁজ নিয়ে দেখতে। আজ সাহেদ এসে জানায় সে রাতে সেখানে আমি ছাড়া আর কেউ ছিলনা। কিছুটা অবাক লাগে। সাহেদ বলা শুরু করে যে,পুলিশ নাকি সেখানে গিয়ে শুধু আমাকে উদ্ধার করে আর হাসপাতালে ভর্তি করায়। মাথায় আঘাত লাগার কারণে বেশি চিন্তা করতে পারছি না। বেশি ভাবলেই মাথাটা ব্যাথায় ফেটে যাচ্ছে। কিছুটা সুস্থ হয়ে যখন বাড়ি ফিরলাম এই একটা ব্যাপার আমায় দিনরাত ভাবাতে লাগলো। যাদের কাছেই সুজাতার কথা জিজ্ঞেস করি আমার দিকে অদ্ভুত ভাবে তাকিয়ে থাকে। মিহান আজ আমায় বলল যে, আমাদের মাঝে কখনই কোনো সুজাতা ছিলোনা। মাথায় যেন আকাশ ভেঙে পড়লো। তবে সেই বর্ষায় বৃষ্টি ভেজা পাগলটা, তবে সেই শরতে কাশফুল নিয়ে এলোকেশী সেই নারী। তবে কি কেবলি কল্পনা। সেই উদ্যানে বসে সূর্যাস্ত কি কেবলি ভাবনা মাত্র। আমার সেই উপহার! আমাকে দেওয়া তার সেই একটা দুটো কবিতা। রবী ঠাকুরের গল্পগুচ্ছ। তবে কি শুধুই ভাবনায় ভালোবাসি?
মতিঝিলের অফিস পাড়ায় সেদিন বেজায় ঝড় উঠেছিলো। চারিদিকে হট্টোগোল আর ছুটোছুটি। ঝিরিঝিরি বৃষ্টি পড়ছে সব মিলে বৈরী আবহাওয়া।হঠাৎ ই মনে হলো সুজাতা একটা প্রাইভেট কারে চেপে বেরিয়ে গেলো। গাড়ির নম্বরটা যতদূর খেয়াল করতে পারলাম ঢাকা মেট্রো গ-১১-১৮২০। নম্বরটা খুব চেনাচেনা মনে হলো। যেই সবেমাত্র সুজাতার চিন্তা মাথা থেকে ঝেড়ে ফেলে বেরিয়েছি অমনিই সেই চিন্তা আবার মাথায় এসে হানা দেওয়া শুরু করেছে। আমার সকল বন্ধুর ভাষ্যমতে সুজাতা বলতে কোনো মেয়ে এই পৃথিবীতেই নাকি বিরাজ করেনা। আমার বিশ্বাস করতে কষ্ট হলেও খোঁজ নিয়ে জানতে পারি আমি ভুল। তবে আজ কেন হঠাৎ ওর চেহারা টা সামনে ভেসে উঠলো?বিআরটিএ তে খোঁজ নিয়ে জানতে পারি গাড়িটির মালকিনের নাম সুজানা জাফর। থমকে যাই আমি। সুজাতার নামও সুজাতা জাফর ছিলো।ওখান থেকে পাওয়া ঠিকানা তে পৌঁছে অবাক হয়ে গেলাম। স্বপ্ন বিলাস নামের একটা বাংলো, যার ঠিক সামনে একটা কৃষ্ণচুড়া গাছ। গাঁদা আর গোলাপ একদিকে, অন্যদিকে সূর্যমুখী। ঠিক যেমনটা সুজাতা আমায় বলেছিল। ওর স্বপ্ন ছিলো। সেদিন আর ভিতরে গিয়ে ওঠা হয়নি। খবর নিয়ে জানা যায় সুজানা লন্ডন থেকে কিছুদিন আগেই মনোবিজ্ঞান বিষয়ে পিএইচডি করে দেশে ফিরেছে। তবে একটা সড়ক দুর্ঘটনায় তার কিছু স্মৃতি মুছে গেছে। হয়ত এটা কোনো কাল্পনিক ঘটনা হয়ে পারে। কিন্তু দুর্ঘটনা কিছুদিন আগে হওয়াটা শুধুই একটা প্রশ্নবোধক চিহ্ন হয়ে রয়ে গেছে। সেদিনের পর থেকে আমি রোজ কৃষ্ণচুড়া ফুল দেখতে একবার হলেও যাই। মাঝে মাঝে বেলকনিতে চোখ গেলে তাকে অবাক হয়ে দেখি। বৃষ্টিতে সেই একই পাগলামো, সেই একই রবিন্দ্রনাথ। তবে সত্যি হলো, আজও কল্পনাতেই ভালোবাসি।
চলবে…
– শফিকুল বারী শিশির
ব্লগার, আতশি ।