মেহেদী (Lawsonia inermis) মেহেন্দী, মেন্দি নামে পরিচিত। আরবি হিন্না থেকে এসেছে। এক ধরনের সপুষ্পক উদ্ভিদ, যার পাতা প্রাচীনকাল থেকে ত্বক, চুল, নখ, পশুর চামড়া ও পশম রঙিন করার কাজে ব্যবহৃত হয়ে আসছে। লসোন(Lawsone) নামক এক প্রকার পদার্থের উপস্থিতির জন্য মেহেদী পাতায় রঙ হয়। মেহেদী পাতা শুকিয়ে গুড়ো করে, বেটে বিভিন্নভাবে ব্যবহার করা হয়। পাতার সাথে অন্যান্য দ্রব্য মিশিয়ে আধা কৃত্রিম পদার্থ তৈরি করা হয়, সেটাও মেহেদী নামেই পরিচিত।
বাংলাদেশে মেহেদী ছাড়া কোনো অনুষ্ঠানই পরিপূর্ণতা পায় না। ঈদ, বিয়ে, যেকোনো অনুষ্ঠানেই মেহেদীর ব্যবহার অপরিহার্য হয়ে উঠেছে। শুরুতে এর ব্যবহার ছিলো সামান্য। হাতে গোল বৃত্ত এবং এর চারপাশে বৃত্ত দিয়ে নকশা করার মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিলো। কিন্তু বর্তমানে মেহেদী এক ধরনের শিল্পের জায়গা দখল করেছে। নানা রকম চোখধাঁধানো শৈল্পিক সজ্জায় সেজে উঠে হাত এবং পা। ডিজাইনের বৈচিত্র্যতার সমাহার এই মেহেদীকে ঘিরে। উৎসব ছাড়াও এমনি সময়েও মেহেদী লাগানোর হিড়িক লেগেই থাকে। কোনো রকম এলার্জির সমস্যা বা পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া না থাকায় কখনোই কমেনি মেহেদীর প্রতি আকর্ষণ।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ও গবেষক তৌহিদুল হক জানিয়েছেন, লিখিত কোন দলিল না থাকলেও ইসলামের নবী হযরত মোহাম্মদ (স.) এর মেহেদী ব্যবহারের তথ্য মুসলমানদের এই মেহেদী ব্যবহারের প্রতি উদ্বুদ্ধ করেছে। পরে ভারতীয় উপমহাদেশে মুঘল সাম্রাজ্য মেহেদী দেয়ার প্রথাকে আরও প্রসারিত করে। ভারতীয় উপমহাদেশে এক সময় মেহেদীর ব্যবহার শুধুমাত্র মুসলিম জনগোষ্ঠী বা মুসলিম সমাজের মধ্যে সীমাবদ্ধ ছিল। পরবর্তীতে মুঘল সাম্রাজ্যের জনগণ এটাকে প্রসারিত করে।
অধ্যাপক তৌহিদুল হক বলেছিলেন, বিশ্বের নানা দেশের মেহেদী ব্যবহার হচ্ছে কিন্তু এর কারণ বা উদ্দেশ্য স্থানভেদে ভিন্ন। তিনি জানান, শুরুতে মেহেদীর প্রচলন ধর্মীয় দৃষ্টিকোণের জায়গা থেকে শুরু হলেও পরে এই প্রথাটি সামাজিক ও সাংস্কৃতিক পরিচয় পেয়েছে। তবে এখন মানুষ এটাকে সার্বজনীন রূপে গ্রহণ করেছে।
ইতিহাসের বইগুলোয়, মিসরের ফারাও সাম্রাজ্যে মমির হাত ও পায়ের নখে মেহেদীর মতো রঙ দেখা যায়। তবে সেটা মেহেদী দিয়ে রাঙানো কিনা সেটা নিশ্চিত হওয়া যায়নি।
মেহেদী বাংলাদেশ, ভারত ও পাকিস্তানে ব্যাপকভাবে ব্যবহৃত হয়। মেহেদীর রয়েছে নানা গুণাগুণ। বিভিন্ন রোগের ঔষধ হিসেবে মেহেদী ব্যবহার করা হয়, মেহেদী পাতার রসের সাথে সরিষার তেল মিশিয়ে লাগালে কাঁধের ব্যাথা দূর হয়, মেহেদী চুল পড়া রোধ করতে সাহায্য করে। মেহেদী পাতা থেকে এক ধরনের সুগন্ধি তৈরি করা হতো, বর্তমানে তা আবার উৎপাদন করা হচ্ছে। কাপড় আর চামড়া সংরক্ষণ করতে মেহেদী ব্যবহার করা হয়। পোকা দূর করতেও এর প্রচলন রয়েছে।
উৎসব–আনন্দে মেহেদীর ছোঁয়া না থাকলে উৎসব জমে উঠে না। বিয়েতে বর–কনের হাতে মেহেদী লাগিয়ে হাত রাঙানো আবশ্যক হয়ে উঠেছে। মেহেদী লাগানো এখন অনেকে পেশা হিসেবেও গ্রহণ করেছেন। শুধুমাত্র অসাধারণ মেহেদী লাগানোর জন্য জনপ্রিয়তার কমতি নেই মেহেদী শিল্পীদের। পছন্দ অনুযায়ী মানানসই নজরকাড়া মেহেদী ডিজাইন হাতে উঠাতে চলে আসেন শিল্পীদের কাছে। মেহেদী লাগানো শুধু পেশাই নয়, নেশাও। এর মিষ্টি সুগন্ধ মুগ্ধ করে সকলকে। দৈনন্দিন জীবনে মেহেদীর ব্যবহার এর অপূর্ব রঙের মতোই রাঙিয়ে দিয়েছে উৎসবগুলোকে।
– নিগার মেহেরিন রিনি
যোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগ
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়।